খন্দকার মোশতাক ও এখনকার বিশ্বাসঘাতক।

এখনকার বিশ্বাসঘাতক।

জীবনের তাগিদে অসংখ্যবার চাকুরির পিছনে ঘুরেছি। সরকারি চাকুরির জন্যও চেস্টা কম করিনি, ভাগ্য সহায় হয়নি তাই চাকুরি নামের সোনার হরিণটা আমার অধরাই রয়ে গেলো। বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি চাকুরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য কুমিল্লা থেকে ট্রেনে করে রাজশাহী গিয়েছিলাম পরীক্ষা দিতে। আমার মতো হাজারো চাকুরি প্রত্যাশী যার যার অবস্থান থেকে প্রস্তুত ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য, কোনো একসময় আমারও ডাক আসলো ভাইভা বোর্ডে, অনেক প্রশ্ন ছিলো কিছু প্রশ্নের উত্তর পেরেছি কিছু পারিনি।

অনেক গুলো প্রশ্নের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন একটি প্রশ্ন ছিলো, ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন আমাকে প্রশ্ন করলেন আপনার বাড়ি কোথায়? আমি বললাম কুমিল্লায়। আমার প্রশ্নের উত্তর ধরে একজন স্যার আমাকে প্রশ্ন করলেন আপনিতো কুমিল্লার, বলেনতো বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত ব্যাক্তির নাম যিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন? প্রশ্নের উত্তরে সম্ভবত বলেছিলাম মেজর ডালিমের কথা। ভাইভা বোর্ডের স্যারদের অভিব্যাক্তি দেখে মনে হলো আমার উত্তরটি সঠিক হয়নি। এছাড়াও আরো অনেক প্রশ্ন করেছিলো। পরীক্ষা শেষে আমার উত্তরটি যাচাই করার জন্য ইন্টারনেটে সার্চ করে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক। মনকে শান্তনা দিলাম উত্তর সঠিক হয়নি কি হয়েছে কিছুতো শিখতে পারলাম, জানতে পারলাম।

সেদিনের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জড়িত সকল খুনিদের নামও আমার জানা হয়ে গেলো। খন্দকার মোশতাক ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জানার আগ্রহ দিন দিন বাড়তেই থাকলো। মোটা মুটি অনেক কিছু জেনেছি,বুঝেছি, শিখেছি মানুষ কেনো বিশ্বাসঘাতক হয়।


আরা পড়ুন> কোন দিকে যাচ্ছে ইসলামি মূল্যবোধ


মোশতাকের ব্যাপারে কিছু বলার আগে আমাদের বর্তমান সমাজের প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক। রাজনৈতিক প্রভাবে আমাদের সমাজে এমন কিছু মোশতাক তৈরী হয়েছে, যারা ক্ষমতার জোড়ে অন্যের বিবাহিত বউকে বাগিয়ে নিজের বউ বানিয়েছে। একদিকে সেই পরিবারের সন্তানদের করেছে এতিম, স্বামীকে করেছে স্ত্রী হারা। সমাজে তাদের মান ইজ্জত ডুবিয়ে দিছে নিমিষেই। এখন সেই স্ত্রীর ঘরেই জন্মেছে নিজের সন্তান। এই যে ক্ষমতার দাপট সেটা কি চিরস্থায়ী? কেউ কি বলতে পারবেন ক্ষমতার পালাবদলে, এখনকার সুন্দরি বউটি আবার অন্যের ঘরে চলে যাবেনা?? তা ছাড়াও অভিশাপতো প্রতিনিয়তই হিসাবের খাতায় যোগ হচ্ছেই !! এসবের ক্ষেত্রেও কি কখনো নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে দেখেছেন? সুন্দর ও ফুটফুটে সন্তানদের জন্য দোয়া চাইতেও দেখি, সেটা দোষের কিছু না কিন্তু একই মায়ের গর্বে যে আরো সন্তানগুলো জন্ম নিয়েছে অন্য পিতার ঘরে তাদের জন্য দোয়া করবে কে? তাদের অভিশাপ গুলোর দায় নিবে কে? নিশ্চয়ই আপনাকে ছাড়া অন্য কেহ নয়! এতকিছুর পরও এখনও অন্যের স্ত্রীর দিকে কুনজরে তাকানো এবং সেই কুনজরকে হাসিল করার জন্য মিথ্যা সাক্ষির জবানবন্দি নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকাদের পরিনাম দিনশেষে মোশতাকেরই উদাহরণ হয়ে থাকবে। সেটা আমার বেলায় কিংবা আপনাদের বেলায়, শুধু  দৃষ্টি ভঙ্গি উলোট পালোট করলেই হবে!!


আরো পড়ুন> অনিশ্চয়তার প্রবাস জীবন


আবার ফিরে দেখা যাক মোশতাকের প্রসঙ্গে, শেখ মজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর রহমান যখন মৃত্যু বরণ করেছিলেন তখন তার মৃত দেহটি কিন্তু মোশতাক আহম্মেদই কবরে নামিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালের বিয়েতে মোশতাককেই উকিল দিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে সবাই যখন সোনার তৈরী নৌকা উপহার দিয়েছিলেন, ব্যাতিক্রমী মোশতাক উপহার দিয়েছিলেন সোনার বটগাছ। তিনি সব সময় বলতেন বঙ্গবন্ধু তার কাছে বটবৃক্ষের মতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঠিক আগের দিন নিজের বাসা থেকে হাসের মাংস না জানি মুরগির মাংস রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়েছিলেন। মোশতাককে বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধু তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনাকে বলেছিলেন, ‘যে কোনো সমস্যায় তোমাদের মোশতাক চাচাকে বলো, তাকে ডেকো, তিনি সবসময় তোমাদের পাশে থাকবেন।’ এভাবে অতিভক্তির কৌশল অবলম্বন করে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুব কাছাকাছি চলে আসেন।

ইতিহাসের চাকাকে পেছনে নিয়ে গেলে এ ধরনের আরেকজন ষড়যন্ত্রকারীকে চিহ্নিত করা যাবে। তিনি হলেন মীর জাফর। তার নামের আগে বিষেশন হিসেবে যুক্ত হয়েছে একটি শব্দ- বিশ্বাসঘাতক। ভারতের মুর্শিদাবাদে মীর জাফরের প্রাসাদের মূল তোরণের নামকরণ করা হয়েছে ‘নেমক হারাম দেউল’ বা বিশ্বাসঘাতক গেট। এটা তার প্রাপ্য ছিলো। মার্কিন লেখক  মার্ক টোয়েন যথার্থই বলেছেন, ‘যদি তুমি রাস্তা থেকে কোনো ক্ষুধার্ত কুকুরকে বাড়িতে নিয়ে  লালন-পালন কর, তবে কুকুরটি কখনও তোমাকে কামড়াবে না। এটাই হল মানুষ ও কুকুরের মধ্যে পার্থক্য।’ নিজ সংগঠন, নিজ দল বা গোষ্টি সর্বোপরি দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার লজ্জাজনক কিংবা ভয়াবহ উদাহরণ মানুষ রূপি বেইমানেরাই সৃষ্টি করেছে। আর ইতিহাসের পাতায় তাদের পরিচিতি ঘটেছে বিশ্বাসঘাতক বা বেঈমান রূপে।

কেউ কারও সঙ্গে বেঈমানি করলে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, ‘এট টু ব্র“টি!’ অর্থাৎ ব্র“টাস তুমিও! এই ব্র“টাস ছিলেন প্রাচীন রোমের জেনারেল এবং তৎকালীন  রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারের প্রথম জীবনের বন্ধু এবং অনুগ্রহ গ্রহণকারী। পরবর্তী সময়ে অন্যদের সঙ্গে ব্র“টাসও রাষ্ট্রপ্রধান জুলিয়াস সিজারকে হত্যায় অংশ নেয়, যা মৃত্যুর আগে সিজার কখনোই ভাবতে পারেননি।


আরো পড়ুন> সমাজটাকে বদলাবে কে?


খন্দকার মোশতাক ও এখনকার বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে পার্থক্য আমার কাছে  ‍দৃশ্যমান না হলেও ব্যতিক্রম কিছুতো আছেই। মোশতাক যেহেতু বয়সে বৃদ্ধ ছিলেন সেহেতু অন্যের বউকে বাগিয়ে নিজের বউ বানানোর ষড়যন্ত্র করেননি। কিন্তু এখনকার বঙ্গবন্ধু প্রেমিকরা ক্ষমতার দাপটে অন্যের বউকে নিজের বউ বানায়। এমনকি সেই বউ থাকার পরও বিশ্ববেহায়া ও নির্লজ্বতার মাথা খেয়ে আরো পরকিয়ার দিকে ধাবিত হয়। যদিও সেটা প্রকাশ্যে প্রামনিত নয় কিন্তু ভোক্তভোগির কৌশল মোশতাককেই অনুসরণ করার নিশ্চুপ প্রতিবাদীই মনে করা যায়। ক্ষমতা চলাকালীন কিংবা ক্ষমতার অবসানের পর ভোক্তভোগির প্রতিবাদ যদি মোশতাকের মতোই হয় তাহলে আমি অবাক হবোনা!!

বঙ্গবন্ধুর এমনও কিছু সৈনিক আছে যারা তিলকে তাল বানাতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনা। ক্ষমতা, অর্থ-প্রাচুয্যে, মিথ্যাচার সবকিছুর তাদের কাছে মানানসই। মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রই তাদের হাতিয়ার। অসহায় মানুষদের বিপদে ফেলতে পারলেই তাদের কলিজায় শান্তি লাগে। আল্লাহ রাসুলের পথ অনুসরণতো করছেই না বরং বাধার দেয়াল হয়ে দাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। একজন নারি সেটা আমার মা কিংবা বোন অথবা আপনার মা কিংবা বোন যেই হোকনা কেনো প্রয়োজনে সে ঘর থেকে বের হতেই পারে। তাই বলে সেটাকে ষড়যন্ত্র করে অন্যদিকে ফরোওয়ার্ড করা বিকৃত মানসিকতা ছাড়া অন্য কিছু বলার অবকাশ নেই। এতসব ষড়যন্ত্র করে তাদের লাভটা কি হচ্ছে সেটাই প্রশ্ন রাখলাম!


আরো পড়ুন> প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সমীকরণ


একজন নারি আমার যেমন মা ও বোন কিংবা স্ত্রী, ঠিক একইভাবে মিরজাফর কিংবা মোশতাকের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই ব্যাতিক্রম হওয়ার কথা না। কথা হলো মোশতাক বা মিরজাফর যদি আমার মা বোনের ক্ষেত্রে অবিচার করে আমি কেনো পারবোনা অথবা যদিও পারি তাহলে কি আমাকেও মিরজাফর বলা হবে?! শুধু কি নারিদের ব্যাপারেই বলবো, সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে অসহায় মানুষগুলো কতটা অসহায় জানেন? পান থেকে চুন খষলেই বিপদের অন্ত নেই। অথচ এই যে নামধারী জনৈক নেতা কর্মীরা সমাজটা চুষে খাচ্ছে তাদের বেলায় সমাজের উচুস্তরের মানবেরা নিশ্চুপ কেনো?

সমাজের নব্য তথাকথিত নেতাদের অপকর্ম সংক্ষিপ্ত তালিকা আপনাদের সামনে তুলে ধরাযাক। নিরীহ মানুষের উপর জুলুম অত্যাচার, নারিদের নিয়ে যৌন ষড়যন্ত্র করা, সরকারি খাসজমি দখল করা, আলেমদের মৌলবাদী বলা, নিজের কথা মতো না চললে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা, বিরোধী মত কিংবা রাজনীতি করলে হামলা মামলা ইত্যাদি করা। নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই স্কুল কমিটিতে থাকা। নামাজ রোজা না পড়লেও মসজিদ কমিটিতে থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। উল্লেখিত সবগুলো যদি আপনি সমর্থন করেন তাহলে আপনি ভালো না করলে খারাপ। পক্ষান্তরে আপনার সমর্থন সমাজের ক্ষতির কারন।

একটি সমাজে অনেক ধরনের মানুষের বসবাস। সুশীল, শিক্ষিত, বুদ্ধিজিবি তারা কেনো এসবের প্রতিবাদ করছেনা, কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও তাদেরকে নিভৃত করে রাখার মতো উদাহরণ কম হবেনা। এভাবে চলতে থাকলে আর যাইহোক সমাজটা যে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সুতরাং আসুন সমাজের এসব নিচু মনস্কের কিটদের বিরোদ্ধে এখনই সোচ্চার হই। সত্যর জয় চিরকাল, মিত্যা সে তো ক্ষনিকের আস্ফালন।  আমি আমার অবস্থান থেকে আপনি আপনার অবস্থান থেকে বিতারিত করুন এসব ভন্ড ভাওতাবাজি সেলফিবাজ নেতা তথা সমাজের বিশ্বাস ঘাতকদের। তাহলেই বলা যায় ভবিষৎ প্রজন্ম অন্তত মোশতাকের মতো কাউকে দেখতে পাবেনা।  ধন্যবাদ

আরো পড়ুন> ধনী গরিবের বৈষম্য


লেখক : মামুন সরকার

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন