নানা অনিশ্চয়তা-সংশয়, দুঃখ-কষ্ট, বেদনা সবকিছু মিলে প্রবাস নামের অঘোষিত জেলখানায় থাকার অভ্যস ধীরে ধীরে রপ্ত হয়ে গেছে। পরিবারকে সুখে রাখতে, নিজের ভবিষ্যতকে সুন্দর ভাবে পরিচালিত করতে, জীবনের শেষ সময়টুকু একটু সুখে কাটিয়ে দেবার নিরন্তন প্রচেস্টার শুরু সেই বছর তিনেক পূর্বেই। অভাবের তারনায় পিস্ট হয়ে প্রবাস নামের জেলখানায় আসার ইচ্ছাটা ছিল প্রবল। উচু দালান, দামি গাড়ি, মসৃন বাহারি খানদানি পোশাক পরার স্বপ্নটা নিজের মনে পুষে ছিলাম অন্ধ নয়নে, লোভে ও প্রলোবনে। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রান পেয়েছি যখন, জন্মদাত্রী মা, জন্মদাতা পিতা, জীবনসঙ্গীনি স্ত্রী, রক্তের ধন শিশু সন্তানটিকে বিদায় দিয়ে এসেছিলাম। বিরহ বেদনায় তাদের চোখের কোনের জল এখনো যে আমাকে তারিয়ে বেড়ায়। শত কস্টের মাঝেও আড়ালে নিজেকে উজ্জীবিত,সুখী মানুষ হওয়ার চেস্টার কোনো ঘাটতি নেই। মাস শেষে পরিবারের অন্ন,বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারলেই নিজেকে সুখী মনে করি। নিজের চাহিদা মেটাই জোড়াতালি দিয়ে। বিলাসিতার অভাবের কথা বলিনি, বেচেঁ থাকতে হলেতো খেতে হবে সেটার কথা বলছি; পরিবারের সব ব্যবস্থা করার পর অবশিস্ট যা থাকে তা দিয়েই মাস চালিয়ে যাওয়ার চেস্টা করা।

অনিশ্চয়তার প্রবাস জীবন।

মানুষের বেচেঁ থাকার নিত্য প্রয়োজনীয় অপরিহার‌্য উপাদান খাদ্য, পানি, বায়ূ, তার একটির সাময়িক ঘাটতি হলেও মৃত্যুর চিন্তা মাথায় এসে যায়। বিশেষ করে হতভাগা প্রবাসি যারা মাঝে মধ্যে এসব অভাবের বাস্তব মুখোমুখি হতে হয়। আল্লাহ প্রদত্ত বায়ূর ঘাটতি না হলেও পানির কৃত্তিম সংকট জীবনকে দুর্বিসহ করে দেয়। সৈরাচারী নীতির মতো কোনো রকম ঘোষনা ছাড়াই পানির সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া আবার তাদের মন মতো পানির সাপ্লাই চালু করাই যেন নীতি। শহর অঞ্চলের প্রবাসিদের বিকল্প পানির ব্যবস্থা একেবারেই শূন্য। খাল-বিল, পুকুর জলাশয়ের চিন্তা করা যেন মরুভূমির মধ্যে পানির সন্ধান করার মতো। প্রচলিত জীবন যাত্রায় মাঝে মধ্যে পানির সংকট মেনে নিলেও, পুরো একটি মাস আল্লাহর সন্তুষ্টি পালনের জন্য রোজা রেখে প্রবাস নামের জেলখানায় ঈদের আনন্দ বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে খুশি করার জন্য অন্তত ওয়াজিব দুই রাকাত নামাজ তো পড়তে হবে। পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী করোনা ভাইরাসের কারনে মানুষের চলাচল সীমিত করা, একসাথে জমায়েত হয়ে নামাজ না পড়া সহ নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার নিয়ম সবাই যথাযথ ভাবেই পালন করছে। এমতাবস্থায় অন্তত নিজের ঘরে নামাজ পড়া থেকে বঞ্চিত করা কতটা মানবতা ও ইসলাম বিরোধী পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম। বঞ্চিত করা এজন্যই বললাম ঘুম থেকে উঠে রান্না করা, গোসল করার জন্য যখন পানির সুইচ চালু করে দেখি পানি নাই। তখন কি করা যায়। বুক ভরে দীর্ঘ নিঃস্বাস ফেলে আল্লাহর কাছে বিচার দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। হায়রে জীবন আর কত কস্ট দিবি মোরো!!!

ভৈাগলিক কারনে সময়ের ব্যবধান থাকায় সবকিছু একসাথে উপভোগ করা যায় না । আজকে মালয়েশিয়া ঈদ, আগামিকাল বাংলাদেশে। মালয়েশিয়াতে যখন ঈদ বাংলাদেশে তখন সবাই রোজা থাকে। ঈদের দিন ছুটি মিললেও পরের দিন ডিউটিতে অবশ্যই যেতে হবে। কিন্তু পরের দিন যে বাংলাদেশে ঈদ। যেভাবেই হোক পরিবারকে একটু হলেও সময় দিতে হবে কথা বলার জন্য। এবার কপালেও তাও জোটলো না। বসের ফোন মামুন ক্যান ইউ হ্যাল্প মি, আমি বললাম অফকোর্স বস, হাও ক্যান আই হ্যাল্প ইউ? ওকে মামুন লিসেন টু-মি, ডিও টু ঈদ-উল ফিতর, ফ্রম টুডে ইউ হ্যাব টু ডু স্টার্ট নাইট জব, বিকজ কারেন্টলি আওয়ার ম্যানপাওয়ার ইজ ভ্যরি শট, আমি বললাম ইটস ওকে বস, নেভার মাইন্ড, আই ক্যান ডু নাইট জব, নো প্রবলেম। ব্যাস, বস বললো সাতটায় ডিউটিতে আসতে। নাইট করতে হবে এজন্য একটু ঘুমিয়ে নিলাম। অথচ বাংলাদেশে আজকে ঈদ উদযাপন চলতেছে। সব বাদ দিয়ে চলে এলাম ডিউটিতে। পরিবারের সাথে ঈদ কেমন কাটছে, কি খাইছো, কি করো এসব শেয়ার করার সৌভাগ্য হলোনা।
কাজে গিয়ে আক্ষেপ ভুলে সেই চিরচেনা যুদ্ধা। এত দুর্ভাবনা আমার মতো মনে হয় আর কেউ ভাবে না। তা নাহলে এই বয়সে মাথার চুল কেনো সাদা হবে?

বুঝ হবার পর শত শত স্বপ্নের অকাল মৃত্যু দেখেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়ার পাশাপাশি অভাবের তারনায় লোভী হয়ে আক্ষেপ করি। জীবন নামের রেলগাড়িটা কোথায় গিয়ে থামবে। এখনো ইস্টিশনের খোজ মেলেনি। যখন অন্যের সুখ দেখে নিজেকে অল্প সময়ে বড়লোক হওয়ার ইচছা জাগে। এই অল্প সময়ে বড়লোক হওয়ার ইচ্ছায় আমাকে কতবার কাদিয়েছে এটা নাই বললাম। হচ্ছে না হচ্ছে না, আবার কিছুই ছিলোনা; এখনতো কিছু হলেও আছে। কত সান্তনা কত ব্যধনা সব একাকার। দিন শেষে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব করলে প্রাপ্তির পাল্লাই ভারি। সভ্যতাটা যখন আধুনিক, মানুষ হিসেবে আধুনিক হওয়ার চেস্টাও কম করিনি। অভাবের গ্লানি পিছন টেনে ধরে রেখেছে। আদিমকালের নিয়মে চলি আমি আমার মতো।

প্রবাসে বড় ভাইয়ের মতো একজন আমার একটি লেখা পত্রিকায় দেখে, এবং ফেসবুকের কিছু স্ট্যাটাস দেখে আমাকে উপদেশ দিলো আমি কেনো শুধু দুঃখের কথাই লিখি, আনন্দ-হাসির কথা নিয়ে কেনো ষ্ট্যাটাস দেই না। তাকে তার মতো উত্তর দিয়ে মনে মনে বলি, জীবন যার দুঃখে বড়া সে আবার সুখের কথা লিখবে। প্রয়োজন থেকে অভাবের সৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম, মা-বাবার দোয়া, আল্লাহর কৃপায় আমি কিছুটা হলেও কেড়েছি মানুষের দৃষ্টি। জীবনের লক্ষ্যটা অনেক বড় হলেও অনেক সীমাদ্ধতায় নিজেকে মেলে ধরতে পারিনি আজও । পরিবার থেকে অভাবের শিক্ষাটা ষোল আনা পেলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে অভাবের কাছে গলাটিপে হত্যা করে, জীবন যুদ্ধে নেমেছিলাম সেই ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই। যেভাবেই হোক মাঝখানের ইতিহাস না হয় নাই বলি ।

উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নটা পুরনের ধারপ্রান্তে গিয়েও হলোনা। চলে এলাম অনিশ্চয়তার প্রবাস জীবনে। নিজের সুখ বিসর্জন দিতে ইচ্ছে করে যদি জন্মদাতা জনক-জননীর একটু সুখ হয়। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে তেমন ভাবি না। সারাক্ষন শুরু দুশ্চিন্তায়, অনিশ্চতায় থাকি পরিবারের কিছু হলোনাতো!!! বাবা নামের মানুষটি তার জীবনে যে কত কস্ট করেছে তার সীমাহীন বর্ননা করে শেষ করা যাবে না। স্বপ্ন ও ইচছা একটাই অন্তত বাবা মাকে যদি একটু সুখে রাখতে পারি। আল্লাহ আমার সহায় হোন। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। সময় পেলে অন্য একদিন বাকিটা লিখবো। আজ যাচ্ছি তবে একেবারে নয় কারন আমাদের মতো অভাগার কথা শুনার জন্য পৃথিবীতে কিছু মানুষ হলেও আছে। যারা হয়তোবা আমাদের মতো কারো কথা শুনার অপেক্ষায় থাকে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ধন্যবাদ।



লেখক : মামুন সরকার
মালয়েশিয়া প্রবাসি, মুরাদনগর, কুমিল্লা, বাংলাদেশ।
তারিখ : 26 মার্চ 2020 দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন