প্রবাসিরা কস্টের টাকায় কি করে?

প্রবাস জীবন।

যে কারনেই হোক দেশের মায়া ছিন্ন করে হাজার মাইল দিগন্তের যান্ত্রিক হাওয়ায় ভেসেই হয়েছি পরবাসি। সীমাহিন স্বপ্ন নিয়ে প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করছি জীবনের সাথে। শুধু আমি নই, প্রত্যেকটা প্রবাসি ভাই ও বোনেরা আমার মতোই। শুধু কাজ আর কাজ, তিন বছরের প্রবাস জীবনে অসংখ্যা মানুষকে ভুলে গেছি মনের অজান্তেই। এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে আরো।

বিভিন্ন জাত, ধর্ম, বর্ণ, দেশি-বিনদেশী কত মানুষের জীবন সংগ্রাম দেখেছি এই আমি। শুধু সংগ্রামই বলবোনা তাদের কাছ থেকে জেনেছি অনেক, শিখেছিও অনেক। পরবাসে প্রথম ভিনদেশী ভাষা মালয়। ইংরেজী বুঝার কারনে তেমন একটা অসুবিধা না হলেও মাতৃভাষাতো সবার কাছেই প্রিয়। যাইহোক সেদিকে বেশিদূর যাচ্ছিনা। প্রবাস জীবন কত কস্টের সেটা কাউকে বুঝানোর ক্ষমতা একজন প্রবাসির নেই বললেই চলে। প্রবাস নামক শব্দটি বলতেই যেনো মনের মধ্যে আচমকা একটা ধাক্কা লাগে। সুখ গুলো বিলীন করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, কতটি কাল অতীত হয়েছে জীবন নামের হিসাবে, সেই হিসাব রাখার মানুষ দুনিয়ায় থাকলেও অর্থের মোহে সেসবের কোনো পাত্তাই নেই।

আমি অসংখ্যবার বুঝাতে চেয়েছি, প্রবাস জীবন কতটা কস্টের, কতটা বেদনার, কতটা লাঞ্চনার। আজো কেউ মনের কথাটি বুঝার চেস্টা করেনি। দেশ থেকে মনে করে সুখের কোনো অন্ত নেই প্রবাসিদের। ঘুরে ফিরে টাকার প্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় দেশের মানুষ। 

প্রবাসিরা কস্টের টাকায় কি করে?

আমরা যে প্রবাস নামের জেলখানায় দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করছি বেলাশেষে সেই পরিশ্রমের প্রতি কতটুকু সৎবিচার করতে পারছি? দেশ থেকে এই আমাদেরকে কেউ বলে রেমিটেন্স যোদ্ধা, কেউ বলে জীবন যোদ্ধা। যে যাই বিষেশনে বিশ্লেষন করুক না কেনো প্রকৃত পক্ষেই আমরা যোদ্বা। প্রতিটা মূহুর্ত কাটে অজানা সংঙ্কায়, পরিবার ভালো আছেতো? সীমাবদ্ধ চার দেয়ালের ভিতর থেকেই চলে সমস্ত ভাবনা, পরিকল্পনা। কস্টকে আড়াল কড়ার জন্য আমারা অনেকেই নেশাকে বেছে নেই। কস্টকে সাবাড় করার জন্য যদি নেশাই হয় একমাত্র অবলম্বন তাহলে আল্লাহর বিচার কেনো মানতে পারবোনা? অবশ্যই আল্লাহ তার প্রতিদান কর্মক্ষেত্রে, প্রবাস জীবনে এমনকি দুনিয়া ও আখেরাতে পর্যন্ত দিবেন এটাই আমার বিশ্বাস। আমার কথা হলো এতো কস্ট করে টাকা কামিয়ে প্রবাসিরা কস্টের টাকায় কি করে?

প্রবাসে কাজ না করলে টাকা নেই এমনকি এখানে থাকারও অধিকার নেই সুতরাং কাজ করতেই হবে। শত কাজের ফাকে অবসর সময়টুকু কি করি? এই প্রসঙ্গটি নিয়েই একটু গভীরে যেতে চাই। এখানে যত প্রবাসি ভাইবোন আছে আনুমানিক তাদের প্রায় ৫০% বিবাহিত বাকি ৫০ অবিবাহিত। উপরে থুথু মারলে নিজের উপরই পড়বে। তবুও কিছু কথার অবকাশ নেই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কস্টার্যিত অর্থ কি পরিবার পাচ্ছে? এখানেই প্রশ্ন, প্রবাসিরা কস্টের টাকায় কি করে? অধিকাংশই সাময়িক অবৈধ সুখের আশায় যৌনাচার কাজে অবিবাহিতরা তাদের যৌনতৃপ্তির স্বাদ মিটায় টাকার বিনিময়ে, সবাইকে বলছিনা। যাদের ডানা শিখলে বন্দি, তারা এসব থেকে শত কস্টে বিরত থাকলেও ডানা মেলে উড়া মানব পাখিগুলো তাদের যৌবনের সমস্ত চাহিদা অপূরণ রাখছেনা। অবলিলায় করে যাচ্ছে পাপের পাল্লা ভারী। তাদের ধারনা হয়তো পরিবারের কেউতো দেখছে না। পরিবার না দেখুক, আল্লাহ কিন্তু ঠিকই দেখছেন। অবৈধ কোনো কিছুরই যেমন ইসলাম সমর্থন করেনা তেমনি পরিবার তথা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও একই রকম। নিজের কৃত পাপের বোঝা পরিবারের উপর যে বরতাচ্ছেনা সেটা আমাদের কারো কারো এখনও শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। অর্থাৎ আমি যদি আমার পরিবারের অগচোরে বিশেষ করে আমার স্ত্রীর হককে বিসর্জন দিয়ে যৌনাচার করি, তাহলে আমার স্ত্রী যে অন্যকারো সাথে কিছু করবেনা সেটা আমি নিশ্চয়তা দিতে পারবো না। তবে প্রচলিত পুরুষ সমাজে নারীদের বেলায় পরকীয়া বা যৌনাচারকে যেভাবে দেখা হয় ঠিক একইভাবে পুরুষের বেলায় কিন্তু দেখা হয়না। শত শত- হাজার হাজার পুরুষ নামের কলঙ্করা কিন্তু এসবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে করেই যাচ্ছে তাদের পাপাচার।

কষ্টের মাঝে অবৈধ সুখ

মদ/বিয়ার/হুইস্কি প্রবাসের সমস্ত দু:খ কস্ট মেটায় মদের নেশায়। কেউ যে কিছু বলবে তারও কোনো প্রন্থা নেই। স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছেনা!! কস্টকে আড়াল করতে যদি নেশার উপর ভরসা করা হয়, সেটাই কি আমাদের জন্য সমাধান? আমরা কি আল্লাহ রাসুল ও ইসলামের আদর্শকে লালন করে চলতে পারিনা? আল্লাহ মানুষের কৃত কর্মের উপর ফলাফল দিয়ে থাকেন। বিপদ দিয়ে মানুষকে পরিশুদ্ধ করেন। তার জীবনের গুনাহ মাফ করেন, এই আল্লাহর বিধান, আমরা যারা মুসলমান হিসেবে নিজেকে দাবি করি, আধৌ কি আমাদের মধ্যে কোনো বিবেক, বিচার বিদ্যমান? যদি তাই থাকতো শত বিপদেও মদের নেশায় নিজেকে মন্ত না করে আল্লাহর উপরই ভরসা রাখতাম। এভাবে কস্টের মাঝে অবৈধ সুখ খোজা আমার কাছে গ্রহনযোগ্য না। এতো পরিশ্রম করে কস্টার্যিত অর্থকে মদ, বিয়ার, হুইস্কির পিছনে ব্যয় করে প্রবাসির সুনামকে ক্ষুন্ন করার কোনো মানে হয়না। প্রবাসিরা যে কস্ট করে সেটার প্রতিদান দেশের বিবেকবান মানুষ যথেষ্টই দিয়ে থাকে। কস্টের প্রতিদান দিয়ে যদি অপকর্মের অপবাদ দেয় সেটা সমগ্র প্রবাসির উপর অঘোষিত ভাবেই বর্তায়।

ক্যাসিনো বা জুয়া খেলে রাতারাতি বড়লোক হয়ে দেশে গিয়ে আরাম আয়েশে দিনযাপন করার স্বপ্ন প্রায় অধিকাংশ লোভী প্রবাসির। কারো উপর কোনো জোড় জবস্তি নেই। জিতে গেলে খুশিতে আত্বহারা, হেরে গেলে নেশা করে শান্ত হওয়ার চেস্টা। মাস শেষে পরিবারের সাথে ছলছাতুরি করে বুঝ দেওয়া। জুয়া খেলা হারাম, একই সাথে জুয়ার অর্থও হারাম। সেটা আমরা বুঝি ঠিকই কিন্তু মানিনা। আমার পরিচিত অনেককেই দেখেছি নিয়মিত নামাজও পড়ে আবার ক্যাসিনোও খেলে। আমি  একটু এডভান্স বলতে চাই কেউ রাগ করবেন না, অনেকে এমনও হয়তো আছে যারা ক্যাসিনোতে জেতার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে!! অথচ মদ জুয়া পরকীয়া আল্লাহ সরাসরি নিষিদ্ধ করেছেন।

জীবনের প্রায় সিংহভাগ সময়ই প্রবাসে কাটিয়েছে শুধু টাকার নেশায়, এমন দুর্ভাগা অনেক রয়েছে। তাদের স্ত্রী সন্তানদের শুধু টাকা দিয়েই সন্তুষ্ঠ রেখেছে, আদর মায়া মমতার বদলে। স্ত্রীকে তার স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করার হাজারো উদাহরণ রয়েছে আমাদের মতো প্রবাসীদের। বছরের পর বছর ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে শুধু টাকার পাহাড় বানাচ্ছে, স্ত্রী সন্তাদের স্নেহ মমতা থেকে বঞ্চিত করে। আমরা কি এসব থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবোনা? নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করলেই সমাধান হওয়ার কথা। টাকাই সব কিছু নয় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাও অনেক বড় উদাহরণ।

পরিশেষে বলতে চাই, প্রবাস জীবনে পরিবার নেই, স্ত্রী সন্তান, মা-বাবা কেহই নেই। এখানে আমরা যা খুশি তাই করতে পারবো। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে, এখানেই যদি আমরা মারা যাই একদিকে পরিবারের স্ত্রী হবে স্বামী হারা, মা-বাবা হবে সন্তান হারা, সন্তান হবে পিতৃ হারা। একই সাথে কৃত পাপকর্মের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কঠিন বিচারের সম্মূখিনতো হতেই হবে!! কাজেই আল্লাহর দয়া ও পরিবারের মায়া পেতে আমাদের সকলকে অবশ্যই সৎ পন্থা অবলম্বন করে প্রবাস জীবনকে বিদায় দিয়ে মাতৃভূমিতে যাওয়াই হবে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কেউ যদি বলে প্রবাসিরা কস্টের টাকায় কি করে? আমি বলবো প্রবাসিরা কস্টের টাকায় পরিবার চালায়, নিজের ভবিষৎ গড়ে, রেমিটেন্সের টাকা দেশে পাঠিয়ে দেশের চাকা সচল রাখে। কেউ যেনো অপবাদ দিতে না পারে প্রবাসিরা কস্টার্যিত টাকা অবৈধ পথে ব্যয় করে।  আমাদের সকলকে আল্লাহ বুঝার তৌফিক দান করুক আমিন।


লেখক : মামুন সরকার।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন